
কুড়িগ্রামের ৪০ বছর বয়সী আছর উদ্দিন ছমির, যিনি শিশুর মতো আকার ও আচরণে জীবন যবয়স প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই, অথচ দেখতে যেন আট-দশ বছরের একটি শিশু। এমনই এক বিরল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আছর উদ্দিন ছমির। উচ্চতা মাত্র ৪০ ইঞ্চি। শুধু বাহ্যিক অবয়বই নয়, আচরণ-চরিত্রেও তিনি শিশুদের মতোই—সারাদিন খেলাধুলায় মেতে থাকেন পাড়ার ছোটদের সঙ্গে।
উপজেলার তিলাই ইউনিয়নের পশ্চিম ছাট গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা আজিম উদ্দিন ও আছিয়া বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে ছমির দ্বিতীয়। জন্ম থেকেই তার মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। শরীরের গঠন না বাড়লেও বয়স বাড়ছে ক্যালেন্ডারের পাতায়। মানসিক অবস্থাও বয়সের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে।
জন্ম থেকেই শিশুর মতো
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুর মতো শরীর ও মন নিয়ে বড় হয়েছেন ছমির। ভোটার আইডিতে বয়স কম থাকলেও বাস্তবে তার বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই। তবে তার দৈহিক বৃদ্ধি আটকে আছে শিশুবেলায়ই। গ্রামের শিশুরা যেখানে স্কুলে যায়, লেখাপড়া করে—সেখানে ছমির দিন কাটায় খেলাধুলা আর হাসি-আড্ডায়।
গ্রামের দোকানি আছর উদ্দিন বলেন, “ছমিরকে ছোটবেলা থেকেই একই রকম দেখে আসছি। কোনো পরিবর্তন নেই। সে খুব সহজ-সরল। প্রায়ই দোকানে এসে বসে থাকে। কেউ কিছু দিলে খায়, কারও সঙ্গেও কখনও ঝগড়া করে না।”
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী লিমা ও জিনিয়া জানায়, “আমরা ছমির ভাইয়ের সঙ্গে সারাদিন খেলি। উনি খুব ভালো, কখনো রাগ করেন না।”

দুশ্চিন্তায় পরিবার
ছমিরের মা আছিয়া বেগম বলেন, “ও একবার কান্না শুরু করলে থামাতে পারি না। আমাদের বয়স হয়ে গেছে। যতদিন বাঁচি ততদিন দেখাশোনা করবো। কিন্তু এরপর? এটা ভাবতেই ঘুম আসে না। সবসময় একটা লোককে ওর সঙ্গে রাখতে হয়। খাওয়া, গোসল, জামাকাপড়—সবই করতে সাহায্য লাগে।”
পিতা আজিম উদ্দিন বলেন, “দিনমজুরির বয়স আর নেই। একটুকরো জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে, কিন্তু উপার্জনের পথ নেই। আমাদের চলে কোনোরকমে। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই—আমার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য।”
ছমিরের পরিবারের দারিদ্র্যতা এতটাই প্রকট যে ছোট ছেলে গার্মেন্টসে চাকরি করে কিছু টাকা পাঠায়, আর স্বামী-স্ত্রী আশেপাশের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। আছিয়া বেগম জানান, ছমিরের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তার ছেলের স্ত্রী হিসেবে ভাগ্নিকে ঘরে এনেছেন, যেন অন্তত একজন পাশে থাকে।
চিকিৎসায় কিছুটা সম্ভব
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু সাজ্জাদ মোহাম্মদ সায়েম বলেন, “এরকম পরিস্থিতির জন্য জিনগত কারণ বা গর্ভাবস্থায় কোনো ত্রুটি দায়ী হতে পারে। গর্ভাবস্থায় আয়োডিন ও পুষ্টিকর খাবার এবং নিয়মিত চিকিৎসা নিলে অনেক সময় এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “ছমিরের মতো রোগীদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসা ও থেরাপি চালানো গেলে তার মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্য কিছুটা হলেও উন্নত হতে পারে।”
সরকারি সহায়তার উদ্যোগ
তিলাই ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বলেন, “ছমিরের নাম প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা পরিষদের সঙ্গে সমন্বয় করে আরও সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
ছমিরের শৈশব আটকে গেছে সময়ের এক অদ্ভুত বন্ধনে। বয়সে সমান তার ভাই আজ সংসার করছে, সন্তানও হয়েছে। অথচ ছমির এখনও সেই ছোট্ট শিশুটি হয়েই রয়ে গেছে। ছেলেকে ঘিরে মা-বাবার ভালোবাসার কমতি নেই, কিন্তু অজানা ভবিষ্যতের ভয় তাদের তাড়া করে প্রতিদিন।
দুর্জয়/ডিএইচ